spot_imgspot_img

অনলাইন সংবাদপত্রের ছড়াছড়ি নেই কোনো নীতিমালা

বাংলাদেশে সব ধরনের মিডিয়ার পরিসংখ্যান থাকলেও অনলাইন মিডিয়ার কোনো পরিসংখ্যান নেই। কোনো নীতিমালা না থাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে অনলাইন সংবাদপত্র। এর ফলে সাংবাদিকতার নামে চলছে যথেচ্ছাচার। সাংবাদিক হিসেবে করা হচ্ছে ক্ষমতা’র অপব্যবহার। ঢাকা থেকে তো বটেই, জেলা সদর এমনকি মফস্বল থেকেও প্রচুর অনলাইন সংবাদপত্র বা পের্টাল প্রকাশিত হচ্ছে। এসবের বেশিরভাগই চলছে ‘কাট-কপি-পেস্ট’ করে। ছাপা পত্রিকার রেজিস্ট্রেশনের বিধান থাকলেও অনলাইন পত্রিকার রেজিস্ট্রেশনের কোনো বিধান এখনো করতে পারেনি সরকার।

মিডিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এভাবে অনলাইন সংবাদপত্রের বিকাশ মিডিয়ার জন্য একটি ভালো লক্ষণ হলেও নীতিমালার অভাবে অনেকেই অপসাংবাদিকতা করার সুযোগ পাচ্ছে। তুলনামূলক অনেক সহজ হওয়ায় অন্য পেশায় থেকেও কেউ কেউ একটি অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে ‘সাংবাদিক’ বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। এদের অনেকেরই সাংবাদিকতার ন্যূনতম জ্ঞান নেই। সামাজিক প্রভাব বিস্তারের জন্যই তারা নিজের প্রতিষ্ঠিত মিডিয়াকে ব্যবহার করছেন। এ ধরনের সাংবাদিকতা ‘মহামারি’ আকারে ছড়িয়ে পড়ার আগেই এটি বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান মিডিয়া-সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শাবান মাহমুদ ভোরের কাগজকে বলেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন সাংবাদিকতা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এ বিষয়ে কোনো নীতিমালা নেই। অনলাইন সাংবাদিকতার বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল নিজেকে মিডিয়াব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাজে পরিচয় দেয়ার লোভ থেকেই অনলাইন মিডিয়ার দিকে ঝুঁকছে। এদের কেউ কেউ সাংবাদিকতার নামে দুর্নীতিও করছে। এর ফলে পুরো সাংবাদিক-সমাজের ওপর কলঙ্ক আসছে। এটি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিক শাবান মাহমুদ বলেন, বর্তমান অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারকে যতো দ্রুত সম্ভব একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এ বিষয়ে এখনই তথ্য মন্ত্রণালয়ের যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়েস স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭৪ সালে প্রথম অনলাইন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। সেটির নাম ছিল ‘নিউজ রিপোর্ট’। এরপর পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন সংবাদপত্র তাদের অনলাইন সংস্করণ চালু করে। তবে সত্যিকারের অনলাইন সংবাদের ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হয় ‘সাউথপোর্ট রিপোর্টার’। এটি ২০০০ সালে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত হয়। সেই তুলনায় বাংলাদেশে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের যাত্রা কিছুটা পরে। তবে বাংলাদেশ খুব বেশি পিছিয়ে নেই। ২০০৫ সালের প্রথম দিকে যাত্রা শুরু করে বিডিনিউজ২৪ডটকম। ২০০৬ সালের ২২ অক্টোবর পুরোপুরি কাজ শুরু করে বিডিনিউজ। এখন পর্যন্ত এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পঠিত অনলাইন সংবাদপত্র। ওয়েবসাইটের র‍্যাংকি প্রতিষ্ঠান অ্যালেক্সার হিসাব অনুযায়ী, বিডিনিউজের ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকি ১ হাজার ৯৬১। বাংলাদেশ র‍্যাংকি ৮।

বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতা অর্ধযুগ পার না করলেও দেশে ছোট-বড় অন্তত ২ হাজার অনলাইন নিউজ-পোর্টাল রয়েছে বলে মনে করছেন সাংবাদিকরা। সেই সঙ্গে সংবাদপত্রের লিঙ্কিং সাইটও রয়েছে অগুনতি। বিভিন্ন সাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে অন্তত সাত-আটশ অনলাইন সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি জেলা সদর থেকে এমনকি উপজেলা সদর থেকেও প্রকাশ করা হচ্ছে অনলাইন সংবাদপত্র। এগুলোর বেশিরভাগই নিয়মিত আপডেট করা হয় না। এমনকি অনেকগুলোতে যোগাযোগেরও নেই কোনো ঠিকানা। ছবি ও তথ্যের যথেচ্ছ ব্যবহার করা হচ্ছে সেসব সাইটে। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও বাংলাদেশীদের মালিকানায় বাংলা-ইংরেজি ভাষায় অনলাইন সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। অবশ্য এসব সংবাদপত্রকে কতোটা সংবাদপত্র বলা যায় তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা।

দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকার নামে এমনকি ব্যক্তির নামেও অনলাইন সংবাদপত্র প্রকাশ করা হচ্ছে। রয়েছে অদ্ভুত নামও। ‘শেষের খবর’, ‘ছবি কথা বলে’, ‘বাঘা নিউজ’, ‘সাভার নিউজ’, ‘আলোকিত জীবন’, ‘ভালো খবর’, ‘বাউফল নিউজ’, ‘গাংনী নিউজ’, ‘ঈশ্বরদী ডটকম’- এ ধরনের অসংখ্য তথাকথিত নিউজপোর্টাল রয়েছে অনলাইনে। এসব সাইট অনেকসময়ই বস্তুনিষ্ঠ তথ্য পরিবেশন না করায় পাঠকরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন।

তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অনলাইন মিডিয়ার প্রসারের ফলে একটি নীতিমালা করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, এ বিষয়ে কাজও বেশ এগিয়েছে। এদিকে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় তথ্য অধিদপ্তর থেকে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড নিতে অনেক অনলাইন পত্রিকার পেশাদার সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আবার অনেকে পেশাদার সাংবাদিক না হয়েও অনলাইন পত্রিকাটির শুধু ট্রেড লাইসেন্স ও ইন-কর্পোরেশন সার্টিফিকেটের জোরে পেয়ে যাচ্ছেন অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড।

অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্রের রেজিস্ট্রেশনের বিষয়ে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (রেজিস্ট্রেশন) ফেরদৌসী বেগম বলেন, অনলাইন মিডিয়ার রেজিস্ট্রেশনসহ নীতিমালার বিষয়ে আমরা মাস ছয়েক আগে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি। এ বিষয়ে যে চিঠি দেয়া হয়েছে তার জবাব আমরা এখনো পাইনি। আশা করি শিগগিরই তা পেয়ে যাবো।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কী কী কারণে রেজিস্ট্রেশন জরুরি তা ওই চিঠির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।

অনলাইন সাংবাদিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এমনও সংবাদপত্র রয়েছে যেটির কর্মীসংখ্যা মাত্র একজন! আবার তারও একাধিক ‘সংবাদপত্র’ রয়েছে। মূলত অন্য সব পত্রিকা থেকে নিউজ কপি করেই সেসব অনলাইন পত্রিকা চালানো হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক অনলাইন সংবাদপত্রেরই প্রয়োজনীয় লোকবল নেই। যারা আছেন তারাও ঠিকমতো বেতন-ভাতা পান না। তাই অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটাতে অনেক ক্ষেত্রেই তারা সাংবাদিক পরিচয়টির অপব্যবহার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

দেশে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির ব্যাপ্তির ফলে ওয়েবসাইট তৈরির ব্যয় অনেক কমে গেছে। সাধারণ মানের একটি সাইট মাত্র তিন-চার হাজার টাকায়ও তৈরি করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে তারও কম লাগে। এর ফলে ঢাকাসহ সারা দেশে অনলাইন মিডিয়ার ব্যাপক প্রসার ঘটছে। এমনও দেখা গেছে, একেকজন কম্পিউটার অপারেটরও একটি সাইট তৈরি করে ‘সম্পাদক’ বনে গেছেন। সংবাদপত্র অফিসের কোনো কোনো অফিস সহকারী এমনকি পিওনেরও অনলাইন পত্রিকা আছে। মূলত কোনো ধরনের আয় না থাকলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিজ্ঞাপনবাবদ ‘চাঁদা’ই তাদের মূল আয়। সেই সঙ্গে গুগলের বিজ্ঞাপনের আশায় অনেকেই নিউজপোর্টাল বানাচ্ছেন। আর নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন ‘সাংবাদিক’ হিসেবে। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাংবাদিক হিসেবে নিচ্ছেন বিশেষ সুবিধা

[তথ্যসূত্র : দৈনিক ভোরের কাগজ]

Get in Touch

spot_imgspot_img

Related Articles

spot_img

Latest Posts