spot_imgspot_img

ক্রাউড ফান্ড: ক্ষুদ্র উদ্যোগ অর্থায়নের নতুন পন্থা

আপনি ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম সমস্যা সমাধানের জন্য চমৎকার একটা উপায় খুঁজে পেয়েছেন। অথবা ক্যামিকেল মুক্ত খাবার বিক্রি করতে চান। আপনার নিকট থাকা পুঁজির বাইরে আরো অর্থ দরকার। কোথায় পাবেন? ব্যাংক? ভুলে যান। তারা তখনই টাকা দেবে যখন আপনার টাকা না হলেও চলবে। অবশ্য এতে ব্যাংক-কে দোষ দেয়া ঠিক না। আম গাছের কাছে কাঁঠাল চেয়ে না পাওয়া গেলে কি আম গাছের দোষ? ব্যাংক জনগণের টাকা আমানত হিসাবে জমা রাখে। সেই টাকা থেকেই ঋণ দেয়। নতুন উদ্যোগ অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হতে পারে। সেক্ষেত্রে উদ্যোক্তার পক্ষে ঋণের টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব হয় না। আর ঋণ নিয়ে কোন উদ্যোগ শুরু করাও উচিত না। সুদের বোঝা প্রথম দিন থেকেই চেপে বসে। কিস্তির বোঝায় ন্যুব্জ হয়ে যেতে হয়। অন্য উপায় হল পুঁজি বা অনুদান। সামাজিক বা জনহিতকর কাজে অনুদান পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ব্যবসার জন্য অনুদান নয়- পুঁজিই সই। পুজি হিসাবে বিনিয়োগে ব্যাংকের সীমবদ্ধতা রয়েছে। ব্যবসায় লোকসান হলে ব্যাংক আমানতের টাকা কিভাবে ফেরত দেবে? নতুন উদ্যোগ শুরু জন্য ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, এঞ্জেল ইনভেস্টমেন্ট আর সাথে ক্রাউডফান্ডিং এখন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

ক্রাউডফান্ড ক্ষুদ্র উদ্যোগ বা ব্যক্তিগত প্রয়োজন দলবদ্ধভাবে অর্থায়নের একটি নতুন প্রক্রিয়া। ক্রাউড মানে আপনি, আমি, তুমি অর্থাৎ আমজনতা মিলেমিশে অর্থ তুলে আপনার বা আমার মত সাধারণ কোন ব্যক্তির ব্যবসায়িক বা সামাজিক উদ্যোগ অথবা নিজস্ব দরকার (আগুনে পোড়া ঘর মেরামত, ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্য সাহায্য)বাস্তবায়নে সহায়তা করা হয়। এতে সোশাল নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে বহুজনের কাছ থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিমাণ অর্থ কোন প্রকল্প বা ব্যবসায়িক উদ্যোগ বা সামাজিক কারণ(শীতার্তদের কম্বল দেয়া) বা জনহিতকর বা জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট (মশা নিধন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান) বা বিভিন্ন সৃজনশীল কাজের (যেমন সঙ্গীতের কোন এলব্যাম, কোন শর্টফিল্ম তৈরী বা পুস্তক প্রকাশনা) জন্য আহবান করা হয়। যারা টাকা তুলতে সহায়তা করে তাদের প্ল্যাটফর্ম বলে। যুক্তরাস্ট্রের কিকস্টার্টার একটি নামকরা ক্রাউড ফান্ডিং প্ল্যাটফর্ম। এ পর্যন্ত তারা ৬১,০০০ হাজার প্রজেক্টের জন্য ২২ কোটি ডলার বা প্রায় ১৭৬০ কোটি টাকা তুলেছে। কিকস্টার্টার অনুদান মডেলে চলে। তারা তাদের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন ধরনের কল্যানমুলক প্রকল্প গ্রহণ করে ও প্রচারণা চালায়। তবে কারো অবকাশ যাপন, নিজস্ব প্রয়োজন (যেমন ডিএসএল ক্যামেরা কেনা, শিক্ষা-বৃত্তি) ইত্যাদি ব্যক্তি স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপার স্যাপার তাদের আওতায় পড়ে না।

ক্রাউড ফান্ডে যারা অর্থায়ন করে তাদের ‘বেইকার’ বলা হয়। তাদের প্রদত্ত অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ধরনের পুরস্কার, স্বীকৃতি ইত্যাদি দেয়া হয়। পুরস্কার গুলোর অর্থমূল্যের চেয়ে শুভেচ্ছা মূল্য বেশী গুরুত্বপূর্ণ যেমন টি-শার্ট, স্টিকার, ধন্যবাদ জ্ঞাপকপত্র। প্ল্যাটফর্ম তাদের সেবার বদলে সার্ভিস চার্জ পায়। একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা উঠলেই তারা এই টাকা পায়। কিকস্টার্টার ৫% চার্জ করে। ইন্ডিগোগো আরেকটি ক্রাউড ফান্ডিং প্ল্যাটফর্ম। তারা ৪% সার্ভিস চার্জ ও ৩% ক্রেডিট কার্ড প্রসেসিং ফি হিসাবে নেয়। যিনি টাকা তুলবেন তার কত টাকা প্রয়োজন তা আগে ঘোষণা করতে হয়। কেউ যদি ঐ পরিমাণ টাকা তুলতে না পারে তবে ইন্ডিগোগো ৯% চার্জ করে। কিন্তু বাকীটা উদ্যোক্তা নিয়ে নিতে পারে। গো-ফান্ড-মি ২০১৪ সালে ৪৭০ মিলিয়ন ডলার তুলেছে।

ক্রাউডফান্ডিং এর মাধ্যমে ২০১২ সালে ২.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার উত্তোলন করা হয়েছে। ক্রাউডফান্ডিং ৪ ধরণের হয়; যথা অনুদান, ঋণ, পুঁজি বা মালিকানা ভিত্তিক ও সহযোগীকে সহযোগীর (পিয়ার টু পিয়ার) ঋণ। ওপেন ডাটা ইন্সটিউটের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে অক্টোবর ২০১০ থেকে মে ২০১৩ পর্যন্ত সারা পৃথিবী জুড়ে ৪৯,০০০ বিনিয়োগকারী ৩৭৮ মিলিয়ন পাউন্ড পিয়ার টু পিয়ার ঋণ দিয়েছে।

ক্রাউড ফান্ডিং’র জন্য বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বিধি বিধান রয়েছে। যেমন আমেরিকায় ১২ মাসে ১ মিলিয়ন ডলার, যুক্তরাজ্যে ১২ মাসে ২.৫ মিলিয়ন পাউন্ড তোলা যাবে। নিউজিল্যান্ডে ১২ মাসে ২০ জন বিনিয়োগকারীর নিকট থেকে ২ মিলিয়ন ডলার উত্তোলণ করা যাবে। অস্ট্রেলিয়ায় ১২ মাসে ২ মিলিয়ন ডলার তোলা যাবে অথবা ২০ জনকে টাকা প্রদান করা যাবে। ফ্রান্সে প্রতি বছর প্রতি ক্যাম্পেনে সর্বোচ্চ ১ মিলিয়ন পাউন্ড তোলা যাবে। কানাডায় প্রতি বছর সর্বোচ্চ ১.৫ মিলিয়ন ডলার তোলা যাবে। কোন কোন দেশ আবার কি ধরণের উদ্যোগের জন্য পুঁজি (ইক্যুটি) ক্রাউড ফান্ড তোলা যাবে তার বিধি নিষেধ দেয়া আছে। যেমন ইটালীতে সে দেশের চেম্বার কর্তৃক স্বীকৃত ৪৮ মাসের কম বয়সী উদ্ভাবনী স্টার্ট-আপের জন্য টাকা তোলা যাবে।

কারা বিনিয়োগ করতে পারবে? ক্রাউড ফান্ডিঙ্গে অনেক ঝুঁকি আছে। হরেক রকম জালিয়াতি হতে পারে। সেটি প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। আমেরিকায় যে কেউ বিনিয়োগকারী হতে পারবে না। এ ব্যাপারে বিধি নিষেধ আছে। একজন বিনিয়োগকারীর বাৎসরিক আয় ১ লাখ ডলারের কম হলে ১২ মাসে ২,০০০ ডলার বা তার সম্পদ বা আয়ের ৫% (যেটি বেশী) প্রদান করতে পারবেন। বিনিয়োগকারীর সম্পদ বা বাৎসরিক আয় ১ লাখ ডলার বা তার বেশী হলে ১২ মাসে তার সম্পদ বা আয়ের ১০% (যেটি বেশী) বিনিয়োগ করতে পারবেন। যুক্তরাজ্যে যে সব বিনিয়োগকারীকে পেশাদার উপদেষ্টারা উপদেশ দেয় অথবা যারা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম বা কর্পোরেট ফাইনান্সের সাথে সংযুক্ত বা যে সব বিত্তশালী (ঝুকি বোঝার সক্ষমতা)পরিক্ষায় উত্তির্ণ তাদের জন্য কোন সিমা নির্ধারন করা নাই। অন্যদের বেলায় বাড়ী ও পেনশন ব্যতীত অন্যান্য সম্পদের ১০% পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবেন। কানাডায় প্রতি বিনিয়োগে ২,৫০০ ডলার এবং বৎসরে সর্বোচ্চ ১০,০০০ ডলার বিনিয়োগ করতে পারবেন। আস্ট্রেলিয়ায় বিনিয়োগ কারী অভিজাত অর্থাৎ কমপক্ষে ২.৫ মিলিয়ন ডলারের সম্পদের মালিক বা পুর্ববর্তী ২ বছরের প্রতি বছর বাৎসরিক আয় কমপক্ষে ২৫০,০০০ ডলার হতে হবে। ক্রাউড ফান্ডিংএ যারা বিনিয়োগ করবে তারা এর অর্ন্তনিহিত ঝুকি বুঝতে হবে। স্টার্ট-আপ কোম্পানী ফটকা ধরণের; অর্থাৎ লাভ হতে পারে, আবার লোকসানও হতে পারে। শেয়ার সহজে নগদায়ন যোগ্য নয়। এমনকি সম্পুর্ণ বিনিয়োগ ‘নাই’ হয়ে যেতে পারে। কোন দেশে, যেমন ইটালীতে, পেশাদার বিনিয়োগকারী ক্রাউড ফান্ডিং পাটফর্মকে ভেঞ্চারের মূলধনের কমপক্ষে ৫% বিনিয়োগ করতে হবে। এক বা একাধিক অভিজাত বিনিয়োগকারীও একই সাথে বিনিয়োগ করেছে। এটার মাধ্যমে খুচরা বিনিয়োগ কারীদের এক ধরণের নিশ্চয়তা দেয়া হয় যে উদ্যোক্তা সঠিক উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করেছে।

যে প্রতিষ্ঠান টাকা চায় তাকে বিভিন্ন ধরণের ঘোষণাপত্র দিতে হয়। বিভিন্ন দেশের নিয়ম নীতি বিভিন্ন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে উক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম, আইনগত অবস্থা, ঠিকানা, ওয়েব ঠিকানা, পরিচালকদের নাম, ব্যবসার বর্ণনা, ভবিষ্যত পরিকল্পনা, আর্থিক অবস্থা, টাকা ব্যবহারের উদ্দেশ্য, প্রার্থিত টাকার অংক, মধ্যস্থতাকারীর পরিচয় ও স্বার্থ, শেয়ারের মুল্য, মুল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়া ইত্যাদি উলেখ করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের (জাম্পস্টার্ট আওয়ার বিজনেস স্টার্টআপ) জবস আইন ২০১২ ক্রাউড ফান্ডিং এর আইনী বিধিমালা সুপারিশ করেছে। জাপানে ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস এজেন্সি আর্থিক ইন্সট্রুমেন্ট এবং বিনিময় আইন ২০১৪ জারী করেছে যা পুঁজি ক্রাউড ফান্ডিং প্রসার ঘটাবে। নিউজিল্যান্ড ২০১৩ সালে আর্থিক বাজার আচরণ আইন জারী করেছে যা পুঁজি ক্রাউড ফান্ড অর্থায়ণ সহায়ক।

ক্রাঊড ফান্ডিং বাংলাদেশে তেমন চালু হয়নি। প্রজেক্ট.কম বাংলাদেশের অন্যতম ক্রাউড ফান্ডিং প্ল্যাটফর্ম। জনহিতকর উদ্দেশ্য, সৃজনশীল প্রকল্প, ব্যক্তিগত প্রয়োজন বা উদ্ভাবণী প্রকল্পের জন্য অর্থ উত্তোলনে তারা সহায়তা করে। এখানে উদ্যোক্তা তাদের উদ্ভাবনী পণ্য আগাম বিক্রি করতে পারে। আঁকিয়ে শিল্প প্রদশর্নীর জন্য টাকা তুলতে পারে। গাইয়ে তার এলব্যাম আগাম বিক্রি করতে পারে। ক্রাউড ফান্ডিঙ্গের ব্যবহারিক রূপ কিন্তু বাংলাদেশ অনেক আগে থেকেই চালু আছে। যেমন সিডর, আইলা বা যে কোন বন্যা, জলোচ্ছ্বাস বা শীতের সময় চাঁদা তুলে অসহায় মানুষদের সাহায্য করা আমাদের দেশের চিরাচরিত একটি দৃশ্য। অনেক পত্রিকা মানবিক কারণে কারো চিকিৎসার জন্য টাকা তুলে দেয়। বিনিময়ে দাতারা তাদের নাম পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে দেখতে পায়। কেউ আবার নাম ছাপানো নয় মানসিক তৃপ্তির জন্য দান করে। মোটাদাগে এটিই অনুদান ক্রাউড ফান্ডিং এর একটি উদাহরণ। আবার অনেকে মাসিক বা সাপ্তাহিক ভিত্তিতে চাঁদা তুলে লটারীর ভিত্তিতে নির্ধারণ করে কোন একজনকে সম্পুর্ণ টাকাটা দিয়ে দেয়। এটি ঋণ ক্রাউড ফান্ডিং। এখানে সমিতি প্ল্যাটফর্মের ভূমিকা পালন করে।

স্টার্ট-আপ বা এসএমই বিকাশে অর্থায়নের নতুন এই পন্থা আমাদেরও কাজে লাগাতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে এর অপব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা যেন প্রতারিত না হয়।

শওকত হোসেন: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিডিভেঞ্চার লিমিটেড।

Get in Touch

  1. আমি একজন ক্ষুদ্র উদ্যেক্তা । নিজ অথআয়নে দুই বছর যাবত পাট শিল্প নিয়ে কাজ করি । পুজিঁ স্বল্পতার কারণে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হইতে হয় । তাই আপনাদের যদি কোন ধরনের সহযোগিতা পাই তাহলে আমার প্রতিষ্ঠানকে সামনে অগ্রসর করতে পারব এবং কিছু লোকের কমসংস্থান সৃষ্টি করতে পারব।

Comments are closed.

spot_imgspot_img

Related Articles

spot_img

Latest Posts